গ্যাস্ট্রিক_নিয়ে_উপদেশনামা

#গ্যাস্ট্রিক_নিয়ে_উপদেশনামা!

আউটডোরে যত রোগী আসে বিশেষ করে মধ্য থেকে বুড়ো বয়সী যত মহিলা তাদের শতকরা ৯৯ জনের কমন সিম্পটম হল গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা! এই সমস্যা যতটা না পাকস্থলীতে নিজে থেকে শুরু হয়, তার চেয়ে বেশি হয় তাদের অভ্যাসগত কারণে!

আমাদের মা চাচীরা জীবনধারণে যথেষ্ট অনিয়ম করেন। তার কিছু নমুনা এরকম,
> তারা সকালের খাবার দুপুরে, তো দুপুরের খাবার বিকালে খান।
> যা খান তাও পরিমাণে অল্প। তাই ভোগেন রক্ত স্বল্পতায়।
> অনেকে আছেন সবাইকে দিয়ে টিয়ে পাতিলের তলায় যে তেল ঝোল জমা থাকে তাই দিয়ে ভাত খান।
> খাবারের সাথে কাঁচা পাঁকা মরিচ বা কারো কারো তো বোম্বাই মরিচ না হলে মুখে খাবারই রোচে না।
> এমনকি তাদের অনেকে 'ঝালেই জাদু' এই নীতিতে বিশ্বাসী। তাই প্রচুর পরিমাণ ঝাল তেল মশলা দিয়ে তারা তরকারী রান্না করেন।
> মেয়ে মায়েরা এমনিতেই পরিবার পরিজন নিয়ে বহু টেনশন করেন। তাছাড়া ঘরের কত কাজ, সব সামলিয়ে ঠিকমত ঘুমাতেও পারেন না। এই অতিরিক্ত স্ট্রেস তাদের সমস্যার একটি অন্যতম কারণ।
> গাঁও গ্রামের অধিকাংশই ফ্যান বিহীন রান্না ঘরে উত্তপ্ত মাটির উনুনে রান্না করেন, গরমে তাই প্রচুর ঘামান। কিন্তু সেই তুলনায় পানি খান কম।
> মহিলা রোগীদের মুখের ভিতরটা আজকাল দেখতে বেশ কষ্টই হয়, কারণ তাদের অনেকেই পান খেয়ে মুখ এমন লাল করে আসেন যে দেখা মুশকিল। দিন রাত তারা পান চিবান, এ ছাড়া তাদের এক মুহুর্তও চলে না। খাবারের রুচি নাই, কিন্তু কেন জানি পান খাওয়ার রুচি তাদের কখনোই কমে না। এটাও তাদের গ্যাস্ট্রিকের একটি অন্যতম কারণ।
> আর একটা সমস্যা যেটা সবাই জানি সেটা হল একটু ব্যাথা বিষ হলেই ফার্মেসির দোকান থেকে খেয়াল খুশিমত ব্যাথার বড়ি খাওয়া।
> গ্রামে প্রচুর শাকসবজি হয়, অনেকেই ভাল ল্যাট্রিন ব্যবহার করেনা। বর্ষাকালে আমজনতার মলে থাকা কৃমির ডিম যায় এসব সবজিতে। অনেকেই সেসব শাকসবজি ঠিকমত ধুয়ে খান না। কোনরকম ক্ষেত থেকে কাঁচা টমেটো শসা কাঁচাই খেয়ে ফেলেন। পেটভর্তি তাদের কৃমিতে, এও গ্যাসের একটি কারণ।
> আমজনতার আর যে একটি বড় প্রবলেম হল - ভাত খাওয়ার সময় তারা সামনে গ্যালন গ্যালন পানি নিয়ে বসেন। পানি ছাড়া তাদের খাবার নাকি গলা দিয়ে নামে না, আটকে আটকে যায়! তাদের এ বদ অভ্যাস উপরের সকল বদ অভ্যাসের অন্যতম। যদিও এ অভ্যাস আছে আমাদের অনেকেরই।

খাওয়ার সময় পানি খেলে যা হয়, তার একটু সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিই,
> খাবার গলা দিয়ে গেলার জন্য পিচ্ছিল মিউকাস বের হয়, পানি খেলে সেই মিউকাস পানির সাথে ধুয়ে উল্টো গিলতে অসুবিধা সৃষ্টি করে, তাই একবার পানি খাওয়া শুরু করা মানে খাবার গিলতে বারবার পানি খাওয়া।
> খাবার খাওয়ার সময় হজমের জন্য যে এসিড তৈরি হয়, পানি খেলে পানি এসিডের সাথে মিশে তাকে পাতলা করে দিতে পারে, যার ফলে এসিডের কার্যকারিতা কমে খাদ্য পরিপাকে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
> কেমিস্ট্রিতে ছোট্ট বেলায় পড়েছিলাম, পানির মধ্যে এসিড ঢালা গেলেও, এসিডের মধ্যে পানি ঢালা বিপজ্জনক। তাই খাওয়ার মাঝে পানি খেলে সেই পানি এসিডের সাথে মিশে তৈরি করে প্রচুর তাপ ও গ্যাস, ফলে খাওয়ার পর অনেকের পেট যায় ফুলে, শুরু হয় পেট গলা বুক জ্বালাপোড়া।

তাই রোগীকে বলে দিতে হবে, প্রয়োজনে খাওয়ার কিছুক্ষণ আগে পানি খেয়ে নেন। আর খাওয়া শেষ করার ২০-৩০ মিনিট পর পানি খান। কিন্তু খাওয়ার মাঝখানে পানি খাবেন না। এই সামান্য একটি অভ্যাসের পরিবর্তন কমিয়ে দিতে পারে তার অনেক বড় সমস্যা। কিন্তু বাস্তবতা হল অনেক সময় আমাদের এই উপদেশগুলো দেওয়ার সময় হয় না। কেউ এসে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার কথা বলেছে তো বাজারে হরেক রকমের anti ulcerant আছে, সেগুলোর কিছু প্রেসক্রাইব করে আমাদের দায়িত্ব শেষ। রোগী যতদিন খায়, ততদিন ভাল। তারপর আবার আসে, আমরা আবার লেখি, বা রোগী নিজ দায়িত্বে ফার্মেসি থেকে কিনে কিনে খায়। এভাবে খেতে থাকে বছরের পর বছর। প্রথমে খেয়ে মজা পায়, আর পরিণামে পায় সাজা!

কয়েকদিন আগে এক রোগী এল। তিনি এক স্যারকে দীর্ঘদিন ধরে দেখান, আর বিগত এক যুগ ধরে গ্যাসের ট্যাবলেট খান। এখন তার অল্প খেলেই পেট ফুলে যায়, খাবারের তেমন রুচি নাই। বর্তমান চিকিৎসার যুগটা কেমন জানি মাত্রাতিরিক্ত cure capability নির্ভর, সাথে যে কিছু preventive advice দিতে হয় সেটা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই। যার ফলাফল ওষুধের উপর দীর্ঘদিনের নির্ভরশীলতা আর তার adverse effects! ভাবতে অবাক লাগে, ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রিত প্রোডাক্টগুলোর তালিকায় শীর্ষে থাকে anti ulcerant! তারা দুদিন পরপর বাহারী নামে নতুন নতুন ওষুধ নিয়ে হাজির হয়, আর আমাদের শিখায়, 'anti-ulcerant ছাড়া নাকি প্রেসক্রিপশন কমপ্লিট হয় না! যাই দিই না কেন সাথে নাকি গ্যাসের ওষুধ লাগেই!' তারা বিক্রিতে সফল কারণ আমরা তাদের চাহিদা মাফিক মাত্রাতিরিক্ত প্রেসক্রাইব করছি, ফার্মেসির দোকানদার হাতুড়ে সবাই প্রেসক্রাইব করছে, রোগীও আরাম পাচ্ছে। কিন্তু এই আরামে যে পরে ভয়ংকর ব্যারাম হতে পারে তা তো রোগী জানে না। রোগী না জানুক, আমরা তো জানি, কিন্তু প্রেসক্রিপশন লেখার সময় অনেকেই সেসব আর মানি না! রোগীকেও বলিনা, 'সব সময় খাবেন না, নিজের ইচ্ছেমত কিনে খাবেন না, খুব বেশি প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খাবেন। পাশাপাশি দীর্ঘদিন খেলে কি অসুবিধা হতে পারে। যাতে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আর না হয় তার জন্য কি করনীয়, কোন কোন অভ্যাস বর্জনীয়' সেসব আর বলা হয়ে ওঠে না।

অনেকেই শুধু ২০/৪০ এক/দু বেলা একমাস/দুমাস/চলবে লিখে ছেড়ে দিই। বলা হয়ে থাকে Interstitial nephritis হয়ে Acute kidney injury করতে পারে এমন যে drugs গুলো আছে তার মধ্যে অন্যতম একটি Omeprazole! অন্যান্য সমস্যা তো আছেই যা অন্য একদিন বর্ণনা করেছিলাম! তাই কোম্পানির প্রচারে প্রলুব্ধ না হয়ে, আর একটু ভেবে চিন্তে প্রেসক্রাইব করি। ওষুধ তো দিবই, সাথে দু এক মিনিট সময় দিয়ে উপদেশগুলোও যেন দিয়ে দিই। ধন্যবাদ। 🙂